ভালোবাসা বড়ই বিচিত্র! মানুষ হোক কিংবা পশুপাখি, রোজই আমাদের অনেকের চোখেই হয়ত বিভিন্ন ধরনের ভালোবাসার উদাহরণ ফুটে ওঠে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টইনস ডে উপলক্ষ্যে ফেসবুকের পাতায় এমনই এক সুন্দর ভালোবাসার ছবি তুলে ধরেছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।
এই ভালোবাসার গল্পটি স্বস্তিকা ও তাঁর পোষ্যের, সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন মুম্বইয়ের এক অটোওয়ালা। কুকুর, পশু-পাখিদের প্রতি অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের নিখাদ ভালোবাসা রয়েছে। কলকাতায় অভিনেত্রীর দুই পোষ্য কুকুর ফুলকি ও সোনার কথা হয়তবা অনেকেই জেনে থাকবেন। তবে মুম্বইতে স্বস্তিকার সঙ্গে যে পোষ্যটি এই মুহূর্তে রয়েছে তার নাম সাবিত্রী। একদিন রক্তাক্ত অবস্থাতেই কুকুরটিকে উদ্ধার করে এনেছিলেন স্বস্তিকা। তারপর থেকে সে অভিনেত্রীর সঙ্গেই রয়েছে। সাবিত্রী অসুস্থ, ক্য়ানসার আক্রান্ত, তার চিকিৎসাও করাচ্ছেন অভিনেত্রী। কেমো থেরাপি চলছে তাঁরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি সাবিত্রীকে কেমো দিতে নিয়ে যাওয়ার পথেরই গল্প সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন স্বস্তিকা।
ঠিক কী লিখেছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়?
স্বস্তিকা লেখেন, ‘১৩ই ফেব্রুয়ারি সাবিত্রীর ৪ নাম্বার কেমোথেরাপির দিন। এটাই শেষ কেমো, ও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠছে এই এক জীবনে শান্তি। আমার শুটিং এর কাজ ছিল তাই আমার স্পট বয় Awadh এর ওকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার কথা। Awadh ঠিক আমার মতন, কুকুর বেড়ালদের ঘেন্না নেই, একেবারে বুকে আগলে রাখে। সেও কাজ থেকে আসবে, এদিকে OPD একটা সময় বাঁধা, নিজের মর্জি মতন পৌঁছনো যাবেনা। যাই হোক Awadh এর অনেকটা দেরি হচ্ছিল, আর আমার কাজটাও পিছিয়ে গেল তাই আমিই সাবিত্রী কে নিয়ে রওনা দিলাম।’
এরপরই স্বস্তিকার লেখায় উঠে আসে কুকুরকে নিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার বিষয়টি। লেখেন, ‘বম্বে তে আমার গাড়ি নেই, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এই যাতায়াত করি। উবের গাড়িতে অনেক হ্যাপা। বেশির ভাগ ড্রাইভার কুকুর দের তুলতে চায়না। রাস্তার কুকুর হলে তো পুরোটাই দুর্ছাই। তারপর ওদের ক্যানসেল কালচার লেগেই আছে। আর সাবিত্রীও গাড়িতে উঠলে বমি করে। ওকে যেদিন রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম ও বমি করছিল। গাড়ির চালকের সঙ্গে সেকি ঝগড়া! আমি জলের বোতল কিনে বমি পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম তাতেও ড্রাইভারটার মনে হচ্ছিল বোধহয় ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে।’
আরও পড়ুন-ISPL-এর ফাইনাল দেখতে মেয়ে নীতারাকে নিয়ে হাজির, অমিতাভকে দেখতে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন অক্ষয়
নিজের অনুভূতি থেকে স্বস্তিকা লেখেন, ‘কিছু কুকুরদের বদ্ধ একটা বাহনে বোধ করি অসুবিধে হয়। আমার কলকাতার ফুলকি, সোনা-ও গাড়ি তে উঠলেই অসুস্থ বোধ করে। যাই হোক অটো এলো, তাতে চড়ে আমরা বেরোলাম। অনেকটা রাস্তা, প্রায় ১/১.৫ ঘন্টা।’
স্বস্তিকার কথায়, ‘কিন্তু সাবিত্রী সোনার টুকরো মেয়ে, কিছুটা আমার কোলে আর কিছুটা আমার পাশে বসে দিব্যি যাচ্ছে। অটো চালক মাঝেমাঝে পেছনে ফিরে দেখছেন কুকুরটা সিটটার কিছু নষ্ট করলো কিনা! আমি ঠাহর করতে পেরে হিন্দি তে বললাম যে আপনার সিট-এর কিছু হবে না। এতটা রাস্তা, ওর একটু অসুবিধে হচ্ছে বলে ছটফট করছে। এও বললাম যে ওর ক্যান্সার এর ট্রিটমেন্ট চলছে। তাই হসপিটাল যাচ্ছি। আমি যেতে যেতে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে ফোনে কথা বলছিলাম । ওনার সঙ্গে হিন্দিতে বলতে উনি বললেন আমিও বাঙালি। আচ্ছা কুকুরদের এইরকম মানুষের মতন রোগ হয়? বললাম মানুষের যা হয় ওদেরও তাই হয়। মানুষের যা হয়না ওদের সেইসব অসুখও হয় কিন্তু আমার মেয়েটা এখন অনেক ভালো আছে।’
এরপরই স্বস্তিকা জানান, ‘হসপিটালটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে, গলির মধ্যে তাও ১ কিমি হবে। আমি ভাবছি যে এই এত ভেতরে তো অটো পাওয়া যাবেনা। আগে কয়েকবার দেখেছি ভেতরে অটো পাওয়া যায়না, উবেরও ক্যানসেল করে দেয়। আগেরবার আমি আর Awadh অর্ধেক অর্ধেক রাস্তা ওকে কোলে করে নিয়ে গেছিলাম। সেই মেইন রোড থেকে যানবাহন পাওয়া গেছিল। ভাবছি ফেরার সময় একা একা এতটা রাস্তা কী করে কোলে করে নিয়ে যাব? আর কেমো নেওয়ার পর ও একটু ঝিমিয়ে পরে, ক্লান্ত হয়ে যায়, হাঁটিয়ে তো কোনও মতেই নিয়ে যাওয়া যাবেনা।’
আর এরপরই অভিনেত্রীর মনের কথা হয়তবা কেমনে বুঝতে পেরেছিলেন মুম্বইয়ের ওই অটোচালক দাদা। স্বস্তিকা লেখেন,'নামার মুখে চালক দাদাকে টাকা দিতে যাচ্ছি, ভদ্রলোক বললেন আপনি ফিরবেন তো আজকে? আমি কি অপেক্ষা করব ? আমি বললাম হ্যাঁ ফিরব কিন্তু সময় লাগবে বেশ অনেকটা। প্রায় এক দেড় ঘণ্টা, এতক্ষণ আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন? আপনার রোজগার এর ক্ষতি হবে। উনি বললেন না না আপনি ওকে নিয়ে ভেতরে যান। আমি বাইরে আছি। গেট থেকে বেরোলেই আমায় দেখতে পাবেন।'
যেমন কথা তেমনি কাজ, সত্যি দাঁড়িয়েও ছিলেন ওই অটোওয়ালা। অভিনেত্রী জানান, 'এক দেড় ঘণ্টা পর বেরিয়ে দেখি উনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা বাড়ি ফেরার জন্য বেরোলাম। অটোতে কত গল্প হলো। উনি আগে ভবানীপুরে থাকতেন। এখন হাওড়া। পরিবার বম্বে তেও আছে, আর দেশে মানে হাওড়াতে। ছেলে বি-টেক করছে। উনি বম্বেতে কোথায় থাকেন, সকালে কখন কাজে বেরোন, কখন বাড়ি ফেরেন। প্রত্যেক বছর পুজোর সময় কলকাতায় আসেন। পারলে দুবার আসেন। আমার বাড়ি কোথায়, কে কে আছে, সাবিত্রী কবে থেকে আছে, ওকে কোথায় পেলাম এই সব।
ভারসোভা পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে ওনাকে বললাম আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি ? আর বললাম ফোন নম্বরটা দেবেন ? রাত বিরেতে কখনও প্রয়োজন পড়লে আপনাকে জানাব। দুটো প্রশ্নতেই বললেন নিশ্চই। ওনাকে টাটা বলে আমি মেয়েকে হিসু পটি করাতে গেলাম। আমরা রাস্তা না পেরোনো অব্দি উনি দাঁড়িয়েই রইলেন।'
এই অন্যরকম ভালোবাসার কথা তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেমদিবসে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেতে ভোলেননি স্বস্তিকা। তিনি আরও লেখেন, ‘আজ ভালবাসা দিবস। সহাবস্থান - এই কথাটার সারমর্ম আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব তত ভালবাসায় ভাল থাকব। প্রেমের মানে কি আর শুধু চুমুতে আটকে থাকবে ? যারা একা, সেই অর্থে সঙ্গিহীন তাদেরকেও তো ভালবাসা পেতে হবে। কীভাবে পাবো প্রশ্নের উত্তর - এইভাবে। আমি ভগবানে আস্থা ভরসা রাখা মানুষ। আমার বিশ্বাস ঈশ্বর তাঁর দূত ঠিক পাঠিয়ে দেন। এই ভালো মানুষটির নাম - বিক্রম চৌধুরী। একটা শহর ভালবাসার শহর হয়ে ওঠে তার মানুষগুলোর জন্য, অবলা জীবগুলোর মায়ার জন্য।’
সবশেষে অভিনেত্রী লেখেন, ‘একে অপরকে ভালবাসায় রাখুন, ভালবাসায় থাকুন। রাস্তার কুকুর বেড়ালগুলোকে একটু আশ্রয় দিন। হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস্ ডে’।